লালমনিরহাটে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় হাজার হাজার মানুষের ঢল

মোঃ শরিফুল ইসলাম,লালমনিরহাট সদর প্রতিনিধি

আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেক কিছুই কালের বিবর্তনে আজ বিলুপ্তির পথে। এসব ঐতিহ্যবাহী খেলার মধ্যে একসময় গ্রামবাংলার অন্যতম ছিল ঘোড়ার দৌড় (ঘোড়দৌড়) প্রতিযোগিতা। কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণমূলক এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। তবে এখনও লালমনিরহাটে এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হাজার হাজার নারী পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে আয়োজন করা হয়ে থাকে।

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উপলক্ষে লালমনিরহাটের মাটি ও মানুষের নেতা ও কেন্দ্রীয় বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া কিছু ঐতিহ্যবাহি খেলা প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে উপস্থাপন করে ইতিমধ্যে সমগ্র দেশে সবার নজর কেরেছেন। এসব খেলার মধ্যে দাড়িয়াবান্ধা, চকরচাল, ঠুস, ঘুড়ি উড়ানো, সাঁতার ও অন্যতম খেলা ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। প্রতি বছর নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে এবছরও ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়।

সোমবার (১৪ এপ্রিল) বিকেলে বড়বাড়ি শহীদ আবুল কাশেম মহাবিদ্যালয় মাঠে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা ঘোড় দৌড় উদ্বোধন করেন সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু। চার দিন হবে এই ঘোড় দৌড় প্রতিযোগীতা। আজকে দ্বিতীয় দিনের খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চতুর্থ দিন ফাইনাল রাউন্ডের মধ্য দিয়ে উক্ত খেলার সমাপ্তি অনুষ্ঠিত হবে ।

প্রতিবছরের ন্যায় এবারেও বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উপলক্ষে ও ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে নানা সাজে সজ্জিত করা হয় বড়বাড়ি শহীদ আবুল কাশেম মহাবিদ্যালয় মাঠটি। মাঠে এক কোনায় বসানো হয়েছে ছোট আকারে মেলা। সেই মেলার দোকান গুলোতে হরেক রকমের পোসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। মাঠের এক কোনায় রয়েছে ছোট ছোট বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য ট্রেন, নাগরদেলাসহ বিভিন্ন রাইড। তবে এসবের মধ্যে আগত উৎসুক জনতা ঘোর দৌড়কেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাওয়ারিরা ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তাদের সাথে টগবগিয়ে খুরের আওয়াজ তুলে আসে রঙ-বেরঙের বিভিন্ন প্রকারের ঘোড়া। এ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ও মেলা উপভোগ করতে লালমনিরহাট জেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা ও উপজেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে। এছাড়াও শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ ষাটোর্ধ বয়স্কসহ নানা শ্রেণীপেশার হাজারো মানুষেরও ভিড় হয়। অনেকে আবার ঘোড়াদৌড় দেখতে আগের দিনই স্থানীয় আত্মীয়-স্বজন এবং খেলার মাঠে এসে বসে থাকে।

শুধুমাত্র ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দেখার জন্য সকাল থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সী শিশুরা মাঠে জড়ো হতে থাকেন। উৎসবমুখর পরিবেশে ঘোড়ার দৌড় ও সওয়ারিদের রণকৌশল উপভোগ করতে মাঠের চতুরদিকে হাজির হয় হাজার হাজার দর্শনার্থী। তারা মাঠে দাঁড়িয়ে অনেকে বসে এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন। খেলা শুরু হলে মাঠের চারদিকে হাজারো দর্শকের উচ্ছ্বসিত আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে ঘোড়া আর সেই ঘোড়দৌড় দেখে উৎসাহিত নানা বয়সের দর্শনার্থীরা। দর্শকের মুহুর্মুহু করতালি আর চিৎকারে অন্যরকম আনন্দ বয়ে যায়। এ যেনো চিরায়ত বাঙালির চিরচেনা মিলনমেলা। প্রথম দিনের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতায় ৩২টি ঘোড়া অংশ নেয়। গ্রাম-বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিযোগিতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন আগত দর্শকেরা।

এসব সাওয়ারিদের মধ্যে সবার নজর ছিল সর্বকনিষ্ঠ ১২ বছরের হালিমা বেগমের উপর। চারজনের ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় হালিমা প্রথম স্থান অধিকার করে সবার নজরও কারেন।

লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ থেকে ঘোড়দৌড় দেখতে আসা আলেক মিয়া বলেন, আমি পরিবার নিয়ে বুড়িমারী থেকে ঘোড় দৌড় দেখতে এসেছি। আমার ঘোড়দৌড় দেখতে অনেক ভালো লাগে। ভালো লাগে বলেই পরিবার নিয়ে এখানে আসা। আমি প্রতি বছর পরিবার নিয়ে বড়বাড়ির এই কলেজ মাঠে ঘোড়দৌড় দেখতে আসি।

ঘোড়াদৌড় দেখতে আসা অবুল কালাম বলেন, আমি পাটগ্রাম থেকে ঘোড়াদৌড় দেখতে এসেছি। প্রতি বছর ধরে এখানে ঘোড়াদৌড় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি প্রতি বছর এখানকার ঘোড়াদৌড় দেখতে আসি। এবছরও এসেছি। আমি চাই প্রতি বছর যেনো এখানে ঘোড়াদৌড় ও গ্রামীন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এমন আয়োজনে হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে আবেগ আপ্লুত হয়েছি। এ প্রতিযোগিতা দেখে হারিয়ে যাওয়া ঐহিত্যকে মনে করিয়ে দিবে। তবে এমন আয়োজন প্রতিবছর হলে ভালো হয়। তাহলে মানুষ গ্রামীণ ঐতিহ্য হারাবে না।

ঘোড়াদৌড় দেখতে আসা মাসুমা খানম বলেন, টিভিতে অনেকবার ঘোড়াদৌড় দেখেছি কিন্তু সরাসরি কখনো দেখা হয় নাই। শহরের কোথাও ঘোড়াদৌড় হয় না। তাই বড় ভাইয়ের সাথে নাটোর থেকে থেকে এখনে ঘোড়াদৌড় দেখতে এসেছি। এ আয়োজন দেখতে আমার মতো হাজার হাজার মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন। এই আয়োজনে এখানে এত মানুষের সমাগম হয় শুধু মানুষের মুখে ও সংবাদে দেখতাম, কিন্তু আজ বাস্তবে তা দেখতে পেলাম। এ প্রতিযোগিতা দেখে খুবই ভালো লেগেছে।

শিক্ষার্থী কাইয়ুম বলেন, নিজ গ্রামে ঘোড়দৌড় দেখতে পেরে আনন্দিত। এলাকার মানুষ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে পেয়ে তারা খুবই মুগ্ধ। এ প্রতিযোগিতা দেখে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে মনে পড়ে যায়। এমন আয়োজন প্রতি বছর হলে দেখতে চান বলেও জানান তিনি।

ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী হালিমা বেগম বলেন, আমি নাটোর থেকে বাবার সাথে এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছি এবং এখানে খেলায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থানও অধিকার করেন। এখানে এই প্রতিযোগিতা খুবই আকর্ষণীয় এবং হাজার হাজার দর্শক হয় বাবার মুখে শুনেছি। এখানে এসে এর সত্যতা পেলাম। এজন্য হালিমা আয়োজক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু সাহেবকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

এ প্রতিযোগিতার আয়োজক কেন্দ্রীয় বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, প্রতি বছরের মতো এবছরও ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছে। মূলত গ্রামীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে ও বিনোদনের উদ্দেশ্যেই এ আয়োজন করা হয়। ঘোড়দৌড় ছাড়াও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্য দাড়িয়াবান্ধা, চকরচাল, ঠুস, ঘুড়ি উড়ানো ও সাঁতার খেলারও আয়োজন করা হয়েছে। ৪ দিনের এ প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী ঘোড়ার সাওয়ারদের পুরস্কৃত করা হবে।

তিনি আরো বলেন, প্রতিযোগিতার পাশাপাশি মেলায় দোকানীরা বিভিন্ন ধরনের গ্রামীণ খেলনা এবং বাহারি খাবারের পসরা বসানো হয়। গ্রামীণ এ মেলা প্রতিদিন সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত চলে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে, বাংলার সংস্কৃতি মনে করিয়ে দিতে আর এলাকাবাসীকে আনন্দ দিতেই তার এই সামান্য আয়োজন। গ্রামীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে ও মাদক মুক্ত সামজ গড়ে তুলতে এ আয়োজন করা হয়।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
3,912FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles